Monday, December 30, 2013

ফিরে যাওয়া........

কত সহজেই ছটা বছর কেটে গেলো । আর আজ জীবনের প্রয়োজনের দোটানায় কি বরবে বুঝে উঠতে না পারলেও এটা  সে পরিস্কার বুঝলো  যে কতটা ভালোবেসেছে শহরটাকে । ঢাকা !! এককথায় সবাই  বলবে বসবাসের অযোগ্য শহর, ঘন বসতি, যানবাহনের ধোঁয়া, হহুড় হুড় করে গাড়িতে উঠা , ঝুলতে ঝুলতে গন্তব্বতে যাওয়া আর অনেক বিপদের সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফেরা -নিশ্বাস নিবার জয়গাও মেলে না , কেউ কাউকে চিনেও না এখানে  । পক্ষান্তরে শিমুর গ্রাম "মাদারীপুর"  ! সে এক অপরূপ সৃস্টি , চারিদিকে গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি , বাড়ির কাছেই পদ্দা নদী । আর এখন শীতে গ্রামটি অন্য এক রূপ ধারণ করেছে। সকালবেলা  ঘন কুয়াশা তারপর মিটমিটে রোদ, প্রতিদিন ই খেজুর গাছ থেকে পাসের বাড়ির গরিব প্রতিবেশী মকবুল চাচার রস নামানো , মাটির চুলায় মায়ের তৈরী গরম গরম রুটি আর বেগুন ভর্তা -তার কোনো জুড়ি নাই । আর যদি আসে পিঠার কথা .......তাহলে আর ছোট্ট গল্প হবে না - হবে উপন্যাস। শিমুর গ্রামের সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ হচ্ছে ঢাকা, আর সেই শহরের জন্য তার এই বেদনা ! খুব সামান্য সময় আছে তার হাতে অথচ গোছগাছ বাদ দিয়ে সে বসে আছে একদম চুপ হয়ে , ওমা একি !! শিমুতো কাঁদছে ..... ।



মেয়েটা বরাবরই অনেক দ্বিধাদন্দে ভুগে।  যাকে ভরসা করে তার জীবন চলা সে তাকে আজ একলা ফেলে জীবনের প্রয়োজনে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে , সাথে নিতে পারছেনা কিন্তু একদিন নিবে । তাই প্রয়োজনের তাগিদে ঢাকায় থাকা বা চাকরি করা আর হলো না , এখন থেকে তাকে থাকতে হবে গ্রামে । এতে ব্যথিত হবার তো কোনোকোনো কিছু নাই , যেখানে বিশ বছর কাটিয়েছে, যেখানে সব প্রিয়জনেরা রয়েছে ,যেটা তার শিকড় সেখানে যেতে ব্যথিত হওয়ার কি কিছু আছে ? নাহ ! শিমু এগুলোর কোনো একটির কারনেও ব্যথিত নয় । আজ তার ব্যথিত হবার কারনটাও  ভিন্ন................


 শিমু এই জগতে নেই , মন তার চলে গেছে আজ থেকে ছয় বছর পিছনে । ভরা দুপুর বেলা । একটা কালো ট্রাঙ্ক, বেড  আর সাথে বড় একটা কাপড়ের ব্যগ- দুই জনে ধরে ধরে তিনবার জিরিয়ে সাত তলায় উঠলো । যতটা ভয়ে ছিলো , গোবেচারা স্বামী কেমন না কেমন বাসা ঠিক করবে তার চেয়ে বেশি খুশি ই  হলো ।ছিমছাম সাদামাটা সুন্দর একটা ফ্লাট- একটা শোয়ার ঘর , একটা  খাবার ঘর, ,রান্নাঘর আর একটা ছোট্ট বারান্দা,দুইটা বাথরুম । গোসল হলো - গোসল বললে ভুল হবে আধা গোসল ......বোঝা গেল পানির সমস্যা হই ঢাকা শহরে ।  টোনা যখন খাবার কিনতে রেস্তোরায় গেল বুদ্ধিমতি টুনি  চটকরে সাথে প্রয়োজনীয় যা আছে টা দিয়েই ঘর গুছালো ।  এসময় মাকে খুব মিস করলো , আর বুঝলো মায়েরা কতটা বোঝে ঠিক যা যা দরকার তাই দিয়েছেন । শিমু মুচকি হাসলো  মশারি , পাখা  মোমবাতি আর হাড়ি ধরার লুস্নি নিবার কথা তার একবার ও মনে পড়েনি । গোছগাছ হলো .........তবে আসল গোছগাছ হবে রাতে বা কাল , যখন টোনার মেস থেকে খাট, আলনা আর টেবিল আনা হবে । বাড়িতে কেউ আসলে খুব সহজেই বুঝবে -দুই নব দম্পতির  সংসার  সূচনার গল্প সুরু হলো  ।  বইগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো ইউভার্সিটি ও যেতে হবে , চোখব্যথাটাও তীব্র মনে হলো বুঝলো ঢাকায় ভালো বায়ুদূষণও আছে । ঢাকাতে গাড়ি ঢুকার সাথে সাথে চোখে ম্যাসেজ দিয়েছে এই শহর তার পছন্দ হই নি । শিমুর চোখ দুইটা খুব সুন্দর তবে সেটা ঢাকা থাকে -০.২৫ এর আড়ালে, এখন সেটা ফুলে আর লাল হয়ে বাজে অবস্থা ( এলার্জি) জনিত কারণে । টোনা এসেছে খাবার নিয়ে ......ভাত আর মাছ  , কিন্তু এই মাছটা কোনো দিন দেখেওনি তাহলে খাবেই বা কোথা থেকে । সেদিন জানলো মাছটা হলো রূপচাঁদা, একটু কষ্ট হলো কিন্তু খেলো ।প্লান মোতাবিক  রাতে ফার্নিচার আসলো ঘর ,গুছানো হলো । পরের দিন --যেহেতু ক্লাস আছে  সুতরাং রান্নার বিষয়টা শেষ করে যেতে হবে , কিন্তু চাকু দিয়ে করল্লা ভাজি কাটতে কাটতে বেলা গেল বলে ইউনিভার্সিটি আর যাওয়া আর হলো না । দুই দিন পর রোববার বরের সাথে ,ঘুরে সবার সাথে পরিচিত হলো ক্লাসও করলো , তবে ক্লাস এ নিজেক এলিয়েন বা বিরল  মনে হলেউ পরে সেটা কাটিয়ে উঠেছিল , হঠাৎ অন্য ক্যাম্পাস থেমে নতুন আবির্ভূত হয়েছে বলে ছেলেদের কৌতুহলের কমতি ছিলো না , অনেকের ফিসি ফিসানি আর টাঙ্কি মারখা দৃষ্টি দেখে একটু বিব্রত বোধ হয়েছিল । একা একা বাড়িও ফিরল কিন্তু রিকশায় যেহেতু ঢাকার গাড়িতে উঠার যুদ্ধে পেরে উঠবে না তাই চেস্টাও করলো না । কদিন পরেই যখন ক্লাস টেস্ট হলো আর ফলাফলে সর্বোচ্চ নম্বর পেল তখন বিড়ালটা কেমন যেন বাঘ হয়ে উঠলো , তবে একটা বিপদও বাড়লো কারণ ছেলেরা তখন আরো মনোযোগী হলো । তাদের পাগলামি থামাতে শিমু যে বিবাহিত সেটার রীতিমত প্রমানও করতে হয়েছে ।



 সেই শিমু আর এই শিমু অনেক পার্থক্য .......মুনির চৌধুরী ঠিকই বলেছিলেন      সত্যি        " মানুষ বদলাই , কারণে অকারণে বদলাই " !!   শিমু আজ ভাবনার জগতে হারিয়েই  আছে .....এখনো ভাবছে আর কাঁদছে, আজ তার  কষ্টটা বেড়ে গেছে সব মিলিয়ে বহুগুন - পুরনো দিনগুলো  মনে পরছে। এই শহর তাকে অনেক দিয়েছে, এখানে এসে শিমু জেনেছে বস্তবতা কি জিনিস , অনেক শিখেছে , অনেক পেয়েছে,চালাক হয়েছে । শিমুর মতে - Dhaka is the city of exploring, establishing and updating oneself, it is a city of opportunities. যখন মানুষ নতুন কিছু পায় তখন পুরনোর মূল্যটা ভুলে যাই ,  কিন্তু শিকড়কে অস্বীকারকের সাদ্ধি কার ? ছয় বছরের প্রাপ্তী আর ভালোলাগার ভিড়ে  বিশ বছর ধরে অতীতের প্রাপ্তী নিশ্চয় তলিয়ে যাবে না ? তবে কেন এই হাহাকার ?

সবকিছু যেন আজিই হবার ছিলো ! আকাশের অবস্থা আজ বিশেষ ভালোনা , একে তো শীত , ঘন কুয়াশায় ঢাকা , সূর্যের নাই দেখা , তার উপর ঝুম বৃষ্টি নামবে বলে মনে হচ্ছে । বৃষ্টি নামবে কিনা জানি না তবে  বারিধারার এই ফ্লাটটাতে বৃষ্টি নেমেছে .........একেতো শিমুর ফিরে যাবার বিরহ

মানুষের জীবনে উত্থান আসে , আসে পতন তবুও শিক্ষার যেন শেষ থাকে না । ছাব্বিশ বছর ধরে শিখেই যাচ্ছে তবুও শেখার যেন কথাও কমতি রোয়ে যাচ্ছে ।মা,খালা,ওননীদের কাছে থেকে, জীবন থেকে, পেপার, পত্রিকা ও গল্প থেকে , নাটক, সিনেমা  , প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে , শিক্ষকদের কাছ থেকে কখনো বা ছোট্ট শিশুর কাছে থেকে   ....এভাবে কত ভাবে আমরা শিক্ষা লাভ করি এবং জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আরো শিক্ষা নিতে থাকবে এই মানব জীবন ।কিন্তু সব শিক্ষায় যেন আজ হার মানলো ,ফিরে যেতে হবে শিকড়ের টানে, কিন্তু শিমুর  অবুঝ মন বরই বেপরোয়া   -তার ফিরে যাওয়াটা মানতে পারছেনা । শিমু গ্রামে যাচ্ছে সেখান থকেই চলে যাবে অচেনা অজানা দেশে , আর কখনো ঢাকায় ফেরা হইতোবা হবে না  কিন্তু এই শহরের দেয়া স্মৃতি ও প্রাপ্তি সারা জীবন মনে থাকবে ।
 -

No comments:

Post a Comment